মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪২ পূর্বাহ্ন
মুহাম্মদ আবদুল হামিদ:
ডাক্তারদের অতিরিক্ত ফি আদায়, অমানবিক মুনাফাবাজি, পরীক্ষার নামে হয়রানি, হাসপাতালে ভোগান্তি এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নতুন কিছু নয়। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ লেখালেখিও হয়; রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তবুও নাজুক পরিস্থিতির উন্নতি হয় না। দেশে সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল কম নয়। আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালও আছে। তবুও এদেশের চিকিৎসার হালচাল বরাবরই ভালো নয়। উন্নত ও ভালো চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমণ করতে হয় অনেকের। অধিকাংশ মানুষেরই বিদেশে গিয়ে উন্নত ও ভালো চিকিৎসার সামর্থ নেই! যা আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু এই সামান্য চিকিৎসাটুকুও যদি রোগীরা না পায়, হাসপাতাল ক্লিনিকে ডাক্তার নার্সদের অমানবিক আচরণ আর অবহেলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়Ñতাহলে রোগীরা যাবে কোথায়?
হাসপাতাল-ক্লিনিকে ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীদের অবহেলার শিকার হয়ে অগণিত মানুষ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের অজুহাতে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, রোগীরা কোথায়ও চিকিৎসা পাচ্ছেন না। চরম নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছেন। এমন অসংখ্য উদাহরণ পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। দু’একটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি। নিজে ডাক্তার হয়েও বাবার চিকিৎসা করাতে পারেন নি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকারের মেয়ে ডা. সুস্মিতা আইচ। অন্তত ২০টি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে তার বাবা মারা গেছেন। ডা. সুস্মিতা আইচ বলেন, শ্বাসকষ্ট থাকায় কোনো হাসপাতাল ভর্তি করেনি তার বাবাকে। অথচ তার বাবা ছিলেন কিডনি রোগী। (দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ মে ২০২০ ইংরেজি)
সিলেটের দাড়িয়া পাড়ার বাসিন্দা রেহেনা খানম। তিনি হার্টের রোগী। সাথে এ্যাজমা, ফুসফুসে পানি জমাসহ আরো অন্যান্য রোগও আছে। গত ২৪ এপ্রিল রাত ১টার দিকে হঠাৎ রেহেনা খানমের শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিলে রাতেই সিলেট হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রেহেনা খানম এই হাসপাতালের পুরাতন রোগী, তবুও কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে নির্দিষ্ট বেডে নিতে অস্বীকৃতি জানান। অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর হৃদরোগ বিভাগের ডাক্তারের নির্দেশে রেহেনা খানমের ইসিজি করা হয়। কিন্তু রেহেনা খানমের শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের ডাক্তাররা রোগীকে অন্য কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। উপায়ান্তর না দেখে রেহেনা খানমকে তালতলাস্থ পার্কভিউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এখান থেকেও রেহেনা খানম এবং স্বজনদের সাথে অমানবিক ও ন্যাক্কারজনক আচরণ করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ডাক্তারদের অমানবিক আচরণে অতীষ্ট হয়ে রেহেনা খানম এবং তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা ডাক্তারি পেশার প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। রেহেনা খানমের স্বজনরা সিলেট হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও পার্ক ভিউ হাসপাতালে ওইদিনে কর্মরত ডাক্তারদের অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। (নধহমষধহবংিঁং.পড়স ,২৫ এপ্রিল, ২০২০ইংরেজি)
চিকিৎসার অভাবে অনাগত সন্তানসহ মৃত্যুবরণ করেছেন ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সাজিয়া (২০)। ঘটনাটি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন এলাকার। পরিবারের অভিযোগ, হাসপাতাল ভর্তি করতে চায়নি বলেই তার মেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। সাজিয়ার বাবা আব্দুল জলিল জানান, সাজিয়াকে তারা প্রথমে স্থানীয় একটি ক্লিনিক, পরে খানপুর হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখানেও কেউ সাজিয়াকে ভর্তি করতে চায়নি। কোথায়ও চিকিৎসা না পেয়ে বাড়ি ফেরার পথে অটোরিকশাতেই সাজিয়া মারা যায়। (দৈনিক ইনকিলাব , ২৩ এপ্রিল, ২০২০ইংরেজি)
বিলাল আহমদ চৌধুরী নামক এক ভাই তার বোনের করুণ মৃত্যুর বর্ণনা লিখেছেন ফেইসবুকে। রাতে তার বোনের প্রসব বেদনা শুরু হলে প্রথমে সিলেট ওসমানী মেডিকেলে নিয়ে যান। সেখানে ডাক্তাররা প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যেতে বলেন। এরপর তিনি তার বোনকে নিয়ে নিরাময়, পার্ক ভিউ, উইমেন্স, রাগিব-রাবেয়াসহ বেশ কয়েকটি ক্লিনিকে দৌড়াদৌড়ি করেন। কিন্তু কোথায়ও চিকিৎসা পাননি। অবশেষে অনাগত বাচ্চাসহ দু’জনই প্রচণ্ড অভিমানে চলে গেলো নিষ্ঠুর এই দুনিয়া ছেড়ে। প্রসব বেদনা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি চার হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা পাননি কুড়িগ্রামের সুজিনা বেগম (২৮) নামের এক গৃহবধূ। অবেশেষে মারা গেলেন তিনিও। স্বজনরা অভিযোগ করেছেন চিকিৎসক ও নার্সদের অবহেলার কারণে সুজিনার মৃত্যু হয়েছে।
এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে বিনা চিকিৎসাতেই মৃত্যুবরণ করলো লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খুলনা নগরীর খালিশপুর ও ব্যাট প্রাইমারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র শিশু রিফাত। সে অসুস্থ হলে প্রথমে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাকে ভর্তি নেওয়া হয়নি। এরপর নেওয়া হয় আদ-দ্বীন হাসপাতালে। সেখানেও তাকে ভর্তি নেওয়া হয়নি। এরপর অবস্থার অবনতি হলে রিফাতকে খালিশপুর ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে ভর্তি নেওয়া হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রিফাতকে গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেয়। গাজী মেডিকেলে নেওয়া হলে তারা জানায়, চিকিৎসক নেই। তাই রোগী ভর্তি করা যাবে না। এভাবে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত রিফাত মারা যায়। (দৈনিক ইনকিলাব ৩ এপ্রিল, ২০২০ ইংরেজি)
রাজধানীর ১১টি হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন আমিনুল (৫২)। আমিনুলের স্ত্রী মিনু বেগমের কাকুতি-মিনতি কেউ শুনেনি। এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর। ডাক্তার-নার্সরা কত হৃদয়হীন ও অমানবিক হতে পারে, তার প্রমাণ ওইসব রিপোর্টে স্পষ্ট। মানুষ অসুখ-বিসুখে বেঁচে থাকার আশায় চিকিৎসকদের কাছে যায়। আর অবহেলা ও চরম ভোগান্তির শিকার হয়ে অভিমান নিয়ে নিষ্ঠুর পৃথিবী ছেড়ে পরপারে চলে যায় তবুও এই মানবিক পেশায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের একটু দয়ামায়া হয় না।
এতোদিন অভিযোগ ছিলো পরীক্ষার নামে হয়রানি, মুনাফাবাজি ও অতিরিক্ত ফি আদায়ের। আর এখন করোনাকালীন ভয়াবহ সময়ে অভিযোগ উঠেছে, মানুষকে তার বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করার। করোনার শুরুর দিকে ডাক্তার ও নার্সদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকার অজুহাত দেখিয়ে অধিকাংশ হসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা বন্ধ ছিলো। এখন এগুলো পর্যাপ্ত আছে। তাহলে সাধারণ রোগীরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবে কেন?
ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেমন সরকারের দায়িত্ব তেমনি করোনা হোক বা না হোক সকল রোগীকে সেবা দেওয়া ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দায়িত্ব। কোন উপসর্গ দেখা দিলে কেউ নিজ থেকে বলতে পারবে নাÑসে কেমন রোগী। এটা চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নির্ণয় করতে হবে। দেশে এ পর্যন্ত করোনা ও করোনাপোসর্গ নিয়ে মৃতের সংখ্যা সহস্রাধিক। যারা উপসর্গে মারা গেছে হতে পারে তারা আসলে করোনাতেই মারা গেছে, আবার এমনও হতে পারে তারা করোনায় তারা মারা যায়নি; বরং সাধারণ সর্দি-কাশি, গলাব্যাথা, শ্বাসকষ্ট, ঠাণ্ডা লাগা ও নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। উপযুক্ত চিকিৎসা হলে হয়তো তাদের অনেকেই বেঁচে যেতো। করোনার অজুহাত দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই।
চিকিৎসা একটি মানবিক পেশা। এই পেশার সাথে জড়িত অনেকেই মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সেবায় নিয়োজিত থেকে মরণব্যাধী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন অনেকে। আক্রান্ত আরো অনেকে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই পেশার সাথে জড়িত কিছুসংখ্যক অমানবিক মুনাফাখোররা শুধুমাত্র নিজেদের নিরাপত্তার অজুহাতে সেবা বন্ধ রেখে মানুষকে জরুরি চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না।
সম্প্রতি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্যে বিশেষ নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে জারিকৃত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোনো বেসরকারি হাসপাতালে জরুরি সেবার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কোনো রোগীকে সেবা না দিয়ে ফেরত পাঠানোর সুযোগ নেই। কোনো রোগীকে অন্য হাসপাতালে রেফার করার প্রয়োজন হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর জন্য হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে যোগাযোগ করে রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল রেফার করার সুযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক মালিক সমিতি, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ)-সহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো সরকারি নির্দেশনায় রোগীদের চিকিৎসা বঞ্চিত করা হলে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এই নির্দেশনা যথাযথ বাস্তবায়ন হোক। চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম মৌলিক অধিকার। কোনো অজুহাতে এই অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা যাবে না।
শিক্ষক, জামেয়া আনওয়ারে মদিনা, পশ্চিম ভাটপাড়া, ইসলামপুর, সিলেট।